সুলেখা আক্তার শান্তা:
আমার ছোট মামা ব্রিটিশ আর্মিতে চাকরি করতেন। তাঁর চলনে বলনে ফৌজি ভাবটা আজীবন বহাল ছিল। অনেক গুণের মধ্যে তাঁর একটি দোষ ছিল তিনি ছিলেন দারুন রগচটা ধরনের মানুষ। কথা বলার সময় তিনি উচ্চস্বরে কথা বলতেন। সেটা তাঁর কানে কম শোনার জন্য হতে পারে বলে অনেকে অনুমান করতেন। তাঁর শ্রুতি বিভ্রাটের বিষয়টি যাচাই করার কোন সুযোগ এবং সাহস কারও ছিল না। লোকে তাকে সমীহ করত তাঁর সনিষ্ঠ জীবন যাপনের জন্য। পাক ভারত দেশভাগের পর তিনি কলকাতা থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ এখন বাংলাদেশে চলে আসেন। বাস করতে শুরু করেন নিজ বাড়িতে। মামার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের মামি ছিলেন চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। পুত্র কন্যাদের নিয়ে তার জগত বিচরণেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। মামা থাকতেন তার নির্দিষ্ট ঘরটিতে। খুব একটা প্রয়োজন না হলে সেখানে কেউ প্রবেশ করত না। মামা এ বিষয়ে কোন বিধি নিষেধ জারি করেছিলেন বলে শুনিনি। মামার ছিল বিচিত্র ধরনের কিছু শখ। একটি শখ আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। মামার ছিল দেয়াল ঘড়ি সংগ্রহের শখ। বিচিত্র ধরনের ষোলটি দেয়াল ঘড়ি ছিল তাঁর সংগ্রহে। ঘরের দেয়াল জুড়ে সুন্দর করে সাজানো ছিল সেগুলো। মনে হতো যেন ঘড়ির ছোটখাটো মিউজিয়াম। সে আমলে ইলেকট্রনিক ঘড়ির ব্যাপক প্রচলন তখনো শুরু হয়নি। সবগুলো ছিল স্প্রিং এর চাবি দেওয়া ঘড়ি। মামা নিয়মিত যত্ন করে, চাবি দিয়ে ঘড়ি গুলো সচল রাখতেন। কোন ঘড়ির সময় এক মিনিট এদিক ওদিক হতো না। কোনটার সময়ে গড় মিল হলে সঙ্গে সঙ্গে মামা নিজেই সেটা ঠিক করে ফেলতেন। অতগুলো ঘড়ি প্রতি ঘন্টায় ঢং ঢং শব্দ করে সৃষ্টি করতো এক বিচিত্র শব্দ ব্যঞ্জনা। মামা ঢং ঢং শব্দকে সুন্দর একটি বাংলায় বলতেন ‘ঘড়ির প্রহর বাদ্য’। কৌতুহল নিবারণে মাঝে মধ্যে আমার প্রবেশ ঘটতো মামার ঘরে। ধৈর্য নিয়ে তিনি যথাসাধ্য কৌতূহল প্রশমনের চেষ্টা করতেন। বলতেন এক একটি ঘড়ি সংগ্রহের আদ্যোপান্ত কাহিনী।
মামা অসুস্থ। মা গেছেন মামার বাড়িতে। কী এক প্রয়োজনে মায়ের খোঁজ করতে আমি হাজির হলাম মামার ঘরের সামনে। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পেলাম মায়ের আর্তচিৎকার। বুঝলাম মামা ইন্তেকাল করেছেন। তখন প্রায় সন্ধ্যা। সন্ধ্যার সময় চারিদিকের তৈরি হওয়া গাম্ভীর্যে পরিবেশটা ভারী হয়ে ছিল। দুঃখ ভারাক্রান্ত আমার মনটা হয়ে উঠল ভারী। মাকে অশ্রুসিক্ত দেখে আমিও অশ্রু আপ্লুত হলাম। ঠিক তখুনি ষোলটা ঘড়ি একসঙ্গে ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠলো। আমার মনে হলো ঘড়ি গুলোর ঐক্যতান অন্যদিনের চেয়েও যেন অধিক শব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঘড়ি গুলো যেন বুঝতে পেরেছে তাদের প্রভুর মৃত্যুর পর তাদের অনাথ হয়ে যাবার কথা। অযত্ন অবহেলায় হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে তাদের অস্তিত্ব। আমি উঠানে দাঁড়িয়ে মামার অন্তিম যাত্রায় তাঁর ঘড়ি বহরের করুন বিদায় সম্ভাষণ শুনে বিস্মিত এবং আপ্লুত হচ্ছিলাম।
Facebook Comments Box